Principal Hosne Ara Ahmad
Principal Hosne Ara Ahmad

অধ্যক্ষ হোসনে আরা আহমদ। সিলেটের নারী শিক্ষার অগ্রদূত।

বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গণে জাতি গঠনের এক অভিভাবক অধ্যক্ষ হোসনে আরা আহমদ। সিলেটের নারী শিক্ষার অগ্রদূত। জীবনের দীর্ঘ সময় কেবল নারীদের শিক্ষা, ক্ষমতায়ন, নেতৃত্ত ওসম্মান ও সমাজে মাথা উঁচু করে সম্মানের আসনে বসাবার জন্য  নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। রাষ্ট্র-ক্ষমতা কিংবা কোনো ধরণের রাজনৈতিক অভিলাস তাকে স্পর্শ করেনি। এক মুক্তিযোদ্ধা পরিবার, ৭১ সালে যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন তাঁর স্বামী ডা. শামসুদ্দীন আহমদ। স্বামীর শহীদ হয়ে যাওয়ার শোককে ও তিনি শক্তিতে পরিণত করেছিলেন তার আদর্শ কে সমুন্নত রাখতে।

পশ্চাৎপদ সমাজে অজ্ঞতা, সামাজিক ওধর্মীয় কুসংস্কার, গোড়ামি এবং রক্ষণশীলতার প্রভাবে পুরুষ প্রধান সমাজ ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নারী সমাজের প্রতি উপেক্ষা ও বৈষম্য মূলক দৃষ্টি ভঙ্গি ওআচরনের অনেক যুগে ও কোন পরিবর্তন আসেনি। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে একটি নবজাগরণ প্রচলিত সমাজের রক্ষণশীলতা, কুসংস্কার ও ধর্মের দোহাই দিয়ে নারী জাতির উপর অযৌক্তিক কঠোর বিধিবিধান চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ আন্দোলনের জন্ম দেয়। সিলেটের নারী সমাজও এই নারী জাগরনের প্রভাবে গভীর ভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। এই প্রভাবকে যথাযথ ভাবে বিশ্লেষন করতে গেলে যাদের অবদান স্বীকার করতে হয় যাদের নাম কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করতে হয় তাদের মধ্যে অন্যতম একজন অধ্যক্ষ হোসনে আরা আহমদ।

হোসনে আরা আহমদের জন্ম পয়েলা জানুয়ারী ১৯২৭ ইংরেজী। বাবা আইনজীবী আব্দুল ওয়াহাব চৌধুরী তারস্কুলে পড়ার সময় মারা গেলেন। শিক্ষাঅনুরাগী মাতা মুহিবুন্নেসা চৌধুরীর অনুপ্রেরণায় এক অতি রক্ষণশীল সময়েঅত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী প্রথমে মিশনারি স্কুলতারপর তার সময়ে ক্লাসেরএকমাত্রমুসলিম নারী হিসাবে কৃতিত্বের সাথে  সিলেট সরকারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স ও তার পর সিলেট সরকারি মুরারিচাঁদ কলেজ থেকে বি এ পাশ করেন। স্কুলে পড়ার সময়ই  তিনি রচনা ও বিতর্ক প্রতিযোগিতায় সিলেট থেকে গিয়ে তৎকালীন শিলংয়ের প্রতিযোগিতায় স্বর্ণ পদক পান।  উচ্চতর শিক্ষা নিয়ে নারীদের শিক্ষাগতমান বাড়াবার মায়ের এই অভিপ্রায়ে তিনি সেই ব্রিটিশ আমলে সুদূর কলকতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ ক্লাসে ভর্তি হোন। উল্লেখ যোগ্য আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আমন্ত্রনা পেয়েও তিনিই প্রথম সিলেটের মুসলিম নারী যিনি মেধাভিত্তিক প্রতিযোগীতায় এই স্বনামধন্য  কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার  সুযোগ করে নেন। সেইসময়ে ১৯৪৬ সালে ডাঃ শামসুদ্দিন আহমেদের সাথে তার বিয়ে হয় এবং কলকাতার বিশ্ববিদ্যালয়ে সব ক্লাস শেষ হলেও  দাঙ্গার জন্য পরীক্ষা বন্ধ থাকে এবং পরে ঢাকা বিশ্ববিষদ্যালয়ে তার পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়।

১৯৫০ সালে স্বামীর সাথে ঢাকায় থাকার সময়ে সিলেটের সরকারি মহিলা কলেজপাকিস্তান সরকার বন্ধ করে দেয়। সিলেটের শিক্ষানুরাগী মানুষ এটা  মেনেনিতে পারেননি। বেসরকারি ভাবে কলেজ শুরু করার তৎপরতা শুরু হয়। তখনকার  নারী নেত্রী জোবেদা রহিমেরআহব্বান ও অনুরোধে হোসনে আরা আহমদ সংসার স্বামী সব কিছু ঢাকায় ফেলে রেখে কর্তব্যের টানে চলে এলেন সিলেটে নিজের মায়ের বাড়ীতে। কোলে তখন এক কন্যা ও এক শিশু পুত্র। জোবেদা রহিম বলেছিলেন আর্থিকসংকটের  জন্য রিক্সা ভাড়া ও দিতে পারবনা। স্বামী ডা. শামসুদ্দীনআহমদের উদার মানসিকতার জন্যই তারপক্ষে সম্ভব হয়েছিল এমন কঠিন সিদ্ধান্তগ্রহণ করার।

১৯৫০ সালে সিলেট মহিলা কলেজেরপ্রথমে অধ্যাপক ও পরে অধ্যক্ষের দায়িত্বগ্রহণ করেন। এর পর আর তিনি পিছনে ফায়ার তাকাননি সেই থেকে সিলেট মহিলাকলেজের প্রতিটি সুখ-দুঃখের ইতিহাসেজড়িয়ে রয়েছেন তিনি। মাত্র কয়েকজনছাত্রী নিয়ে ভাড়া করা ছোটো ঘর থেকে তার দীর্ঘ আমলে সিলেট মহিলা কলেজ সারা দেশে সন্মানিত আসন লাভকরে। শহরে নারী সমাজের উন্নয়নের সাথে সর্বাঙ্গীন নেতৃত্ব দেয়ার সাথে সাথে তিনি অধ্যক্ষার গুরু দায়িত্ব পালন করে গেছেন। ১৯৬২ সালে কলেজের জন্যবর্তমানের বাড়ি ও শহরের মাঝখানে চার একর বা বারো বিঘা জায়গা প্রথম বারেরমতো কলেজের নিজস্ব সম্পত্তি হিসাবে ক্রয়করা হয় তারই তত্ত্বাবধানে। ১৯৬৩ সালে ছাত্রী নিবাসসহ কলেজটি তার নিজস্বস্থানে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৬৪ সালে কলেজ টিতে বিজ্ঞান বিভাগ চালু করা হয়এবং ১৯৬৭ সালে বিজ্ঞান বিভাগের জন্যদ্বিতল দালান কোটা তৈরী করা হয়। ১৯৭০সালে দ্বিতল ছাত্রী নিবাসের প্রথম তলানির্মিত হয়; এতে করে সিলেট ছাড়াও অন্যান্য জেলার অভিভাবকগণও নিজের মেয়েদের রাজনীতি মুক্ত পরিবেশে হোষ্টেলে রেখে পড়াশুনা করানোর সুযোগ পেয়েছিলেন। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে পর্দানশীল সিলেট সমাজের  মেয়েরা  নির্ভিগ্নে উচ্চ শিক্ষার জন্য স্বপ্রনোদিত হন। পড়াশুনা যেন ব্যাহত না হয় তাই তার প্রখর দৃষ্টি সকল মেয়েদের উপর থাকতো। পারিবারিক ও আর্থিক সংকট নিরসন করতে ও নীরবে এগিয়ে আসতেন ও সস্নেহে সাহায্য করতেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার  পরে তিনি জাতীয় শিক্ষা পরিবেশ কমিটিতে একমাত্র বেসরকারী কলেজ গুলোর প্রতিনিধি সদস্য মনোনিত হন  এবং সরকারী ও বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে একই পক্রিয়ায় রাখারজন্য আপোষহীন সংগ্রাম করে যান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে দূর্নীতি মুক্ত করে রাখারজন্য তিনি দৃঢ় ভূমিকা রাখেন। তাঁরসময়েই মহিলা কলেজ ফিরে পায় তার  জীবনের চেতনা।

অধ্যক্ষ থাকা অবস্থায় বেগম হোসনে আরা আহমদ পকিস্তান আমলে ১৯৬২ সালেআমেরিকা সরকারের সোশ্যালিষ্ট এক্সচেঞ্জপোগ্রামে আমন্ত্রিত হয়ে আমেরিকার ১১টিস্টেইটের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেন। একই বছর টোকিও এবং হংকং এ তিনি শিক্ষা সফরে যোগ দেন। নারী শিক্ষারঅবদানের জন্য সেই সময় সরকার তাকে "তমগায়ে কায়েদে আজম" খেতাব প্রদানকরে।

সিলেট মাহিলা কলেজ ছাড়াও তিনিসিলেটের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্যতার সময় ও মেধা ব্যয় করেছেননিরলসভাবে। আম্বরখানা গার্লসহাইস্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, আম্বরখানাশিশুস্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী, সোশ্যালওয়েলফেয়ারের যুবাকল্যাণ কেন্দ্রেরসভানেত্রী, ব্লুবার্ড স্কুলের প্রতিষ্ঠাতাসদস্যসহ তিনি ঢাকা ও চট্টগ্রামবিশ্ববিদ্যালয়ের একডেমিক কাউন্সিল ওসিণ্ডিকেটের সদস্য ছিলেন। কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডের সম্মানিত সদস্য হিসাবেও দায়িত্বপালন করেছেন। এছাড়াও তিনি ছিলেনজাতীয় মাহিলা সংস্থার সভানেত্রী, ফেডারেশন অব ইউনিভার্সিটি উইমেন্স-এর সিলেট শাখার সভানেত্রী, জালালাবাদঅন্ধ কল্যাণ সমিতি, টিবি এসোসিয়েশন-এর সিলেট এডুকেশন ট্রাষ্টের একজনসম্মানিত সদস্য। তিনি ওভারসিজসেণ্টারের পরিচালনা কমিটির একজনট্রাষ্টিও। মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারী সমাজেরপূণর্বাসনের জন্য নারী পূণর্বাসনের জাতীযকমিটির নেতৃত্ব দিয়েছেন। সব খানেই তার মেধা ও সাহসিকতার বিরামহীন কার্যক্রমের উদাহরন রেখে গেছেন। ষাট দশকের শেষের দিকে ঢাকা  বিশ্ববিদ্বালয়ে সিন্ডিকেটের মিটিংয়ে তারই প্রস্তাবনায় মিউজিক বিভাগ চালু হয়। বাংলাদেশ হওয়ার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সিন্ডিকেটে মিটিং চলাকালীন ছাত্ররা ঘেরাও করে। ভয়ে যখন কেউ বের হননি তখন এক মাত্র মহিলা সিন্ডিকেটের সদস্য হোসনে আরা আহমেদ ছাত্রদের মাঝে বেরিয়ে যান ও ১৫ মিনিটের মধ্যে তাদের শান্ত করে সমস্যার  সমাধান করে ফেলেন।

১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ সরকারেরপ্রতিনিধি হিসাবে ব্যংককে অনুষ্ঠিতইউনেসকো আয়োজিত শিক্ষা সেমিনারেযোগ দেন। মালেয়েশিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থাওতিনি পরিদর্শন করেন। বিভিন্ন সময়েবিভিন্ন দল থেকে রাজনীতিতে যোগদেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হলেওরাজনীতির মোহ তাঁকে আকর্ষণ করতেপারে নাই। তিনি রাজনীতির মোহপরিত্যাগ করে নারী জাতির শিক্ষা বিস্তারেগুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে থাকেন। তিনি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন ‘শিক্ষা ছাড়া নারী জাতির এগুনোর আর কোন বিকল্প  নেই’। ১৯৮০ সালের ১ মার্চ সরকারী করণের আওতায় আসেসিলেট মহিলা কলেজটি আর ১৯৮৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারী বেগম হোসনে আরা আহমদ যার সাজানো পূর্ণাঙ্গ কলেজকে সরকারের কাছে দিয়ে অবসর গ্রহণ করেন।

দেশ ও দেশের মানুষের জন্য এই মহিয়সীমহিলা শুধু তাঁর নিজের সময় ও মেধা দানকরেননি, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম কালেহারিয়েছেন একান্ত আপন জনকে। ১৯৭১সালের ৯ এপ্রিল পাকিস্তানী হায়েনাদেরহাতে কয়েকজন সহযোগীসহ নিহতহয়েছেন ডা. শামসুদ্দীন আহমদ। ডা. শামসুদ্দীন আহমদ যে মাটিতে ঘুমিয়েআছেন তার থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে হোসনে  আরা আহমদের কর্মস্থল সিলেট মহিলা কলেজটি। এই সম্পর্কে তাঁরস্মৃতিচারণ করতে গিয়ে একবার বলেছেন‘আমার জীবনের যে চরম দূর্ঘটনা ঘটেছিলসেদিন, ঠিক পরের দিন থেকে আমিআমার কর্মস্থলে যোগ দিয়েছি। এইকবরকে সামনে রেখে প্রথম দিন আমারবুকের ভিতর যে রক্তক্ষরণ হয়েছিল তারথেকে শক্তি সঞ্চয় করেই পথ চলেছি আমি, আমার তো হারাবার কিছু নেই’। উল্লেখ যোগ্য ১৯৫০ সালের পর থেকে সিলেটে উচ্চতর নারী শিক্ষার এবং নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য জন্য নিঃসন্দেহে অধ্যক্ষ হোসনে আরার অবদান সব চেয়ে অধিক। নারী শিক্ষার জন্য তার পারিবারিক জীবনকে  আত্মোৎসর্গ ও অতুলনীয়। বিভিন্ন জায়গায় তার স্বামীর চাকুরীর বদলির জন্য খুব কম সময়েই পুরো পরিবার সারা জীবন এক সাথে থাকতে পেরেছেন। একটি বেসরকারি কলেজে কে সম্মানের সাথে অধিষ্ঠিত করতে তিনি সারা জীবন তাকে সিলেটেই থাকতে হয়েছে  অথচ সিলেটে নারী শিক্ষায় তার অবদানের কথা এখন বিস্মৃত প্রায়। ২০০৫ সালে লন্ডনে ভ্রমন কালে ব্যারোনেস পোলা উদ্দিন বলেছিলেন আমি আগে যদি জানতাম লন্ডনের সকল শিক্ষিত মেয়েদের (লন্ডনে  বেশির ভাগ মানুষ সিলেট অঞ্চলের) আপনিই শিক্ষিত করেছেন তাহলে আমি আপনাকে ইংল্যান্ডের রানীর সাথে গর্বের সাথে দেখা করাতাম।

২০১৮ সালের ১৬ জুলাই ৯১ বছর বয়সে তিনি নিউ ইয়র্কে তার ছেলে মেয়ে নাতি নাতনি পরিবেষ্টিত থেকে ইহলোক ত্যাগ করেন।